1. editor@islaminews.com : editorpost :
  2. jashimsarkar@gmail.com : jassemadmin :

সমুদ্রে পাইপলাইনে ত্রুটি, সরবরাহ বন্ধ!

মহেশখালীর ভাসমান টার্মিনাল (এফএসআরইউ) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ শুরুর দুই মাসের মধ্যে আবারো সমুদ্রের তলদেশে সাব-সি পাইপলাইনে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। এলএনজি টার্মিনালের সঙ্গে সমুদ্রের তলদেশের পাইপলাইনের সংযোগস্থলের হাইড্রোলিক ভাল্বটি বিকল হয়ে পড়ার কারণে আবারো জাতীয় গ্রিডনির্ভর হয়ে পড়েছে গ্যাস বিতরণকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)।

চার মাস বিলম্বের পর চালু হওয়া প্রকল্পটিতে দুই মাসের মধ্যে আবার ত্রুটি দেখা দেয়ায় উদ্বিগ্ন জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তা ও খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এ প্রকল্প দেশের জ্বালানি খাতের ভোগান্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষতের কারণ হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। সূত্র জানায়, সাব-সি পাইপলাইনে ত্রুটির কারণে এ মুহূর্তে কেজিডিসিএলের বড় গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে।

শুধু জরুরি প্রয়োজনের ভিত্তিতে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গ্রাহকদেরই গ্যাস সরবরাহ করছে কেজিডিসিএল। আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকায় চাপ পড়ছে জাতীয় গ্রিডের ওপর। ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আবাসিক, বিদ্যুৎ, সিএনজি ও শিল্প খাতে চরম গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। রান্নার জন্য গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না বাসাবাড়িতে।

ফিলিং স্টেশনগুলোতেও দেখা দিয়েছে সিএনজি সংকট। তবে কবে নাগাদ সাব-সি পাইপলাইনের ত্রুটি সমাধান হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না এলএনজি পরিবহনে নিয়োজিত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারের মহেশখালীতে দেশের প্রথম ভাসমান টার্মিনাল থেকে আমদানি করা ব্যয়বহুল এলএনজি সরবরাহ শুরু হয় গত ১৮ আগস্ট।

যদিও টার্মিনালটি চালু হওয়ার কথা ছিল ২৪ এপ্রিল। কিন্তু টার্মিনাল নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদার কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জির অদক্ষতায় চার মাস বিলম্ব হয়। টার্মিনাল থেকে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার কথা থাকলেও গত মাস পর্যন্ত সরবরাহের মাত্রা ছিল ৩০ কোটি ঘনফুট।

এলএনজি পরিবহনে আনোয়ারা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণকাজ সময়মতো শেষ না হওয়ায় দৈনিক ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম পেয়ে আসছিলেন ভোক্তারা। অন্যদিকে এতদিন পর্যন্ত চট্টগ্রামে যা সরবরাহ হয়ে আসছিল, সাগরের নিচে পাইপলাইনে সমস্যার কারণে শনিবার রাত থেকে তা-ও বন্ধ হয়ে যায়।

এ বিষয়ে এলএনজি পরিবহনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান আর পিজিসিএলের উপমহাব্যবস্থাপক কাজী আনোয়ার আযীম বলেন, সমুদ্রের নিচে পাইপলাইনের ভাল্বে সমস্যার কারণে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। আমরা সমস্যাটি সারানোর কাজ করছি। খুব দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলছে। তবে কতদিন লাগতে পারে তা স্পষ্ট করে বলেননি তিনি।

অন্যদিকে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কেজিডিসিএল বলছে, সমুদ্রের তলদেশে গ্যাস সরবরাহ পাইপলাইনের সংযোগস্থলের অকেজো হয়ে পড়া ভাল্ব মেরামতের বিষয়টি জটিল। এনএলজি প্লান্ট স্থাপনে নিয়োজিত মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জি কর্তৃপক্ষকে এরই মধ্যে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলীরা কয়েক দিনের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে কাজ শুরু করবেন। কাজ শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যেই কাজটি শেষ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সে হিসেবে এলএনজি সরবরাহ পুনরায় চালু হতে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। এ বিষয়ে কেজিডিসিএলের প্রকৌশলী (কাস্টমার অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) অনুপম দত্ত বলেন, ১৫ নভেম্বরের আগে এলএনজির সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই আমরা আপাতত জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।

কেজিডিসিএল বিতরণ বিভাগের তথ্যমতে, এলএনজি আমদানির আগে কেজিডিসিএল দৈনিক ২১ কোটি থেকে সাড়ে ২১ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করত। গত ১৮ আগস্ট থেকে আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহ শুরুর পর সেটির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় দৈনিক ৩৮-৩৯ কোটি ঘনফুটে।

শনিবার থেকে এলএনজি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেজিডিসিএলের দৈনিক গ্যাস সরবরাহ আবারো নেমে দাঁড়িয়েছে ২১ কোটি ঘনফুটে। বর্তমানে আবাসিক, মাঝারি শিল্প ও সিএনজিতে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রেখে বড় শিল্প-কারখানায় সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে কাফকোয় এখনো গড়ে চার-পাঁচ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দেয়া হচ্ছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে চট্টগ্রামের সবগুলো সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ।

এ বিষয়ে জাতীয় গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলি মো. আল মামুন বলেন, ভাসমান টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে চট্টগ্রামে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণে একটু সমস্যা হচ্ছে। আমরা আগের সোর্সগুলো থেকে গ্যাস নিয়ে সরবরাহের চেষ্টা করছি।

এলএনজি সরবরাহ শুরুর পর থেকে চট্টগ্রামে নতুন করে কিছু কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস দেয়া শুরু করে সরকার। চালু করা হয় ওই এলাকার সবক’টি সার কারখানাসহ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। কিন্তু এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব শিল্প-কারখানা নিয়ে বিপাকে পড়েছে চট্টগ্রামে গ্যাস বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত কেজিডিসিএল।

আগের গ্রাহক ও বর্তমান গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস নিয়ে এসব শিল্প-কারখানা চালুর চেষ্টা করছে কেজিডিসিএল। গ্যাস সরবরাহ না থাকায় চট্টগ্রামের বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানাগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন কেজিডিসিএলের গ্রাহক ব্যবসায়ীরা।

এদিকে জাতীয় গ্রিডের গ্যাস ভাগাভাগির কারণে চাপ সৃষ্টি হয়েছে রাজধানী ঢাকায়ও। রাজধানীর উত্তরা, আজিমপুর, পান্থপথ, রামপুরা, বনশ্রী, মিরপুরসহ পুরান ঢাকায় দিনের বেলা গ্যাসের চাপ পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। এছাড়া গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার শিল্প-কারখানায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে। তবে বেশি সমস্যা হচ্ছে ঢাকায় বাসাবাড়িতে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪১০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরবরাহ সক্ষমতা রয়েছে মাত্র ৩২৬ কোটি ঘনফুটের। এর মধ্যে ৫০ কোটি আসছে এলএনজি থেকে। গতকাল সারা দেশে সব শ্রেণীর গ্রাহকের বিপরীতে সবক’টি বিতরণ কোম্পানির মোট সরবরাহ ছিল মাত্র ২৭১ কোটি ঘনফুট। ফলে গতকালও দেশে গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি ছিল ১৪০ কোটি ঘনফুট। এর আগে সোমবারও গ্যাস না পেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ছিল ২১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে।

প্রসঙ্গত, দেশে গ্যাসের ঘাটতি পূরণ করে জ্বালানি সংকট সমাধানে ২০১০ সালে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে দেশের প্রথম এলএনজি টার্মিনাল ব্যবহার বিষয়ে ২০১৬ সালে এক চুক্তি করে তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।

চলতি বছরের এপ্রিলে এ টার্মিনালটি চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাইপলাইন নির্মাণকাজে জটিলতা ও অদক্ষতার কারণে চার মাস বিলম্বে গত ১৮ আগস্ট এ টার্মিনাল চালু হয়। ভাল্ব বিকল হওয়ার আগ পর্যন্ত কাতার থেকে আমদানি করা এলএনজি এ টার্মিনালের মাধ্যমে রিগ্যাসিফিকেশন শেষে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করা হচ্ছিল।

এলএনজি আমদানির ব্যয় পরিশোধের পরও টার্মিনাল ব্যবহার বাবদ এক্সিলারেট এনার্জিকে বছরে ৯০ হাজার ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে। চালুর দুই মাসের মধ্যেই ব্যয়বহুল এ টার্মিনালে পাইপলাইনের জটিলতা দেখা দেয়ায় উদ্বিগ্ন জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তা ও খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। পেট্রোবাংলা, আরপিজিসিএল ও তিতাসের কর্মকর্তাদের মধ্যে গতকালও বিষয়টি নিয়ে দিনভর বৈঠক চলে।

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ এনডিসি বলেন, পাইপলাইনের সমস্যাটি চার পাঁচদিনের মধ্যে সমাধান করা হবে বলে এক্সিলারেট এনার্জি আমাদের জানিয়েছে। যেহেতু বিষয়টি যান্ত্রিক, তাই সমস্যা হওয়াটা স্বাভাবিক। এভাবে সমস্যা হতে থাকলে ট্রাবলশুটিং করা হবে।

More News Of This Category