1. editor@islaminews.com : editorpost :
  2. jashimsarkar@gmail.com : jassemadmin :

পথের ধারের খাবার ব্যবসা…

বাঙালিমাত্রই ভোজনরসিক। পাঁচতারকা কিংবা রাস্তার পাশের হোটেল- খাবারের স্বাদে ভোজনপ্রেমীরা ঘুরে ফেরেন সর্বত্র। বাঙালির এই চাওয়াকে প্রাধান্য দিতেই ঢাকার আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে খাবারের ছোট-বড় সব আস্তানা। রাস্তার পাশের ঝালমুড়ি থেকে শুরু করে পিৎজা-বার্গার; প্রত্যেক খাবারেই রয়েছে অভিন্ন স্বাদ।

ঢাকার স্ট্রিট ফুডের নাম জিজ্ঞাসা করলে আমরা পিঁয়াজু, মুড়ি, চানাচুর মাখাতেই আটকে যাই। অথচ এই শহরে কত পদের খাবার শুধু রাস্তায় বিক্রি হয়, তার ইয়ত্তা নেই। শরবত বিক্রি হয় শতাধিক রকমের। চিকেন ফ্রাই থেকে শুরু করে পিৎজা পর্যন্ত সড়কপথেই বিক্রি শুরু হয়েছে।

বর্তমান সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে ফুড এক্সপ্লোর। ভালো হোক আর খারাপ, তা একবার হলেও চেখে দেখতে হবে। তাই তারা শুধু রেস্তোরাঁতেই সীমাবদ্ধ নেই। এলাকার মোড়ে, ঝিলের পাড়ে, বিলের ধারে অথবা রাস্তার পাশে কোনো খাবার দোকানই যেন বাদ পড়ছে না। গত কয়েক বছরে ঢাকায় খাবারে এসবে বড়সড় পরিবর্তন।

ধানমণ্ডি, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ৬০ ফিট, বালুর ব্রিজ, কালশী, গুলশান, বনানী এবং পুরান ঢাকায় গড়ে উঠেছে ফুড হাব। সেই সঙ্গে চলছে স্ট্রিট ফুডের রেভ্যুলেশন। পাল্টেছে স্ট্রিট ফুডের ধারণাও। আগে সমাজের একটা শ্রেণি স্ট্রিট ফুড ব্যবসা করলেও এখন সমাজের শিক্ষিত শ্রেণিও স্ট্রিট ফুডে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আর আগে থেকেই যারা নামের দিক থেকে এগিয়ে আছে, তারাও খাবারটাকে বানিয়ে ফেলছে ব্র্যান্ড।

তাই এসব খাবারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন তরুণরা। যার মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পের মুস্তাকিমের চাপ, গরু-খাসির চাপ, গোল্ডেন বিরিয়ানি, টাউন হল বাজারের সামনের বিহারি ক্যাম্পের মানজারের পুরি, শ্যামলী রিং রোডের আল-মাহবুব রেস্তোরাঁর গ্রিল চিকেন, মিরপুর-১০-এর শওকতের কাবাব, মিরপুর ঝুটপট্টির রাব্বানির চা- এমন অনেক খাবার।

গুলশান-১ থেকে লিংক রোড যাওয়ার পথে ফুট ওভারব্রিজের একটু আগেই জায়গাটা। এই এলাকায় গড়ে উঠেছে হরেক রকম খাবারের মেলা। স্ট্রিট ফুড কিংবা ছোট্ট পরিসরে খাবারের দোকান নিয়ে বসেছেন অনেকে। হালিম, মুড়ি ভর্তা, ফুচকা, দোসা, ছোলা বাটোরা থেকে শুরু করে চা- প্রায় সব রকমের খাবার পাওয়া যায় এখানে।

গুলশানের মতো এলাকা বিচার করলে দামও পকেটের নাগালের কাছাকাছি। গুলশান গুদারাঘাটে স্ট্রিট ফুড কর্নার ‘শাহি খানা’। কয়েকজন ফ্রেন্ড মিলে এই দোকানের খাবার বানানো থেকে প্রেজেন্টেশনেও খানিকটা শাহি মনোভাব হলেও দামের বেলায় আবার ক্রেতাবান্ধব। এই দোকানের মূল আকর্ষণ হলো ‘মুড়ি বানানো’।

২৫ টাকা থেকে শুরু করে ৮০০ টাকা মূল্যের মুড়ি পাওয়া যায় এই দোকানে! ২৫ টাকায় পাবেন মসলা মুড়ি আর ৪০ টাকায় পাবেন আস্ত ডিম দিয়ে মাখানো মসলা মুড়ি। তা ছাড়া মাংস মাখানো মুড়ি তো আছেই। দোসা আর ছোলা বাটোরা হলো মূলত ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের খাবার এবং বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয়।

গুদারাঘাট ইন্ডিয়ান দোসা হাউস। এখানকার দোসা এবং ছোলা বাটোরার দাম মাত্র ৪০ টাকা। রাজধানীর পূর্বাচল বসুন্ধরা সংলগ্ন ৩০০ ফিটে সব রেস্টুরেন্ট উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে অনেক খাবারপ্রেমীই হতাশ। এত কম বাজেট এবং এত বাহারি খাবারের দেখা একসঙ্গে মেলা ভার।

৩০০ ফিটের খাবারের দোকানগুলো খাবারপ্রেমীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে বসুন্ধরা-বারিধারা এলাকাবাসী এবং সেখানকার স্কুল-কলেজের ছাত্রদের জন্য। তবে ৩০০ ফিটের অভাব ঘোচাতে নতুন চমক নিয়ে এসেছে ‘মেট্রো কিচেন’খ্যাত বাংলাদেশের প্রথম ফুড কনটেইনার। পণ্যবাহী কনটেইনার দ্বারা গঠিত এ রকম ফুড কোর্ট বাংলাদেশে আর নেই।

বসুন্ধরা এলাকার অ্যাপোলো হাসপাতালের পেছনে এটি অবস্থিত।প্রায় ২২ হাজার স্কয়ার ফুট জায়গার ওপর বসুন্ধরার দক্ষিণ এভিনিউতে গড়ে উঠেছে এই বিশাল ফুড কনটেইনারটি। খোলা মেলা আকাশের নিচে এখানে আপনি উপভোগ করতে পারবেন বিভিন্ন দেশের খাবার। আমেরিকান, মেক্সিকান, ইতালিয়ান, থাই, জাপানিজ, চায়নিজ আরও নানা ধরনের কুইজিন।

বড় কাচের জারে শরবত গুলিয়ে রাখা আছে। তাতে বরফ ভাসছে। থরে থরে সাজানো গল্গাস। গল্গাসে কেটে রাখা আছে পেঁপে ও আপেল কুচি। শরবতে নয় পদ কী জানতে চাইলে তিনি বললেন- পানি, চিনি, লেবু, তোকমা, পেঁপে, আপেল, ট্যাং ও রুহ আফজা। এখানে রুহ আফজা অপশনাল। ইচ্ছা হলে খাবেন, না হলে নেবেন না।

জাফর মিঞা শরবত বিক্রি করেন। নয়টি উপকরণ দিয়ে তৈরি তার শরবত। বসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলার সামনে। কতটা স্বাস্থ্যকর জানতে চাইলে জাফর মিঞা বললেন, কত ভাজাপোড়া খাচ্ছেন, এখানে ফল আছে। সবই ভালো ফল। ভালো করে ধুয়ে কেটে বানানো। বরফ কোথা থেকে আনেন জানতে চাইলে বললেন, ভালো পানি দিয়ে বানানো বরফকল থেকেই বরফ আনেন।

বাকরখানি- পুরান ঢাকার মানুষ সকালের নাশতায় চায়ে ভিজিয়ে এই খাবারটি খেতে বেশ পছন্দ করেন। শুধু পুরান ঢাকায়ই না, এর জনপ্রিয়তা আরও বিস্তৃত। পুরান ঢাকার জিঞ্জিরার বরিশুর, লালবাগ, নাজিমুদ্দিন রোড, চানখাঁরপুল, কসাইটুলী, নাজিরাবাজার, নবাববাড়ি, নবরায় লেন ও সূত্রাপুরে বাকরখানির বেশ কিছু দোকান ও কারখানা আছে। আপনি যদি ফুচকা ভালোবাসেন, তবে আপনার উচিত পুরান ঢাকার ফুচকা একবারের জন্য হলেও খাওয়া।

চকবাজারের রাস্তার পাশে বেশ কিছু ছোট্ট দোকান রয়েছে, যেখানে পাবেন সেরা ফুচকার সন্ধান। আমরা মোটামুটি ‘ঝালমুড়ি’ বা ‘মুড়িমাখা’ শুনেই অভ্যস্ত হলেও পুরান ঢাকায় এর নাম ‘মুড়ি ভর্তা’। তবে নামের পাশাপাশি ভিন্নতা আছে স্বাদেও। এটি পুরান ঢাকার বেশ জনপ্রিয় খাবারের একটি। বিশেষ করে মসলা জাতীয় খাবারের মধ্যে এটি অন্যতম।

‘ভাজা’ বা ফ্রাই ধরনের খাবারের আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে পুরান ঢাকায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরি। এখানে নানা রকমের পুরি পাওয়া যায়। আলু পুরি, ডাল পুরি, কিমা পুরি, মাংস পুরি, টাকি মাছের পুরি, সবজির পুরিসহ আরও নানা রকমের পুরি তৈরি হয় এখানে। মালাই চায়ের জন্য পুরান ঢাকার খ্যাতি কম না।

পুরান ঢাকার প্রায় সব গলিতেই পাওয়া যায় মালাই চা। মালাই চা বানানোর ক্ষেত্রে দোকানিরাও বেশ যত্নবান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে রয়েছে বেশ কিছু চায়ের দোকান। এ ছাড়া বকশীবাজার, শাঁখারীবাজার, তাঁতিবাজার ইত্যাদি জায়গায় বেশ ভালো স্বাদের মালাই চা পাওয়া যায়।

উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ব্রিজটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা রকম স্ট্রিট ফুডের ভ্রাম্যমাণ দোকান। পাবেন ফুচকা, চটপটি, দই ফুচকা, চিকেন ফ্রাই, চিকেন স্পাইসি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ঝাল পিঠা, চিকেন রোল, নুডলস ও কফি কর্নার।

ইদানীং পান তৈরির এক বিশেষ কৌশল রীতিমতো ঢাকা শহরে শোরগোল ফেলে দিয়েছে। আর সেটা হলো আগুন পান। এই পান খেতে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারে প্রতিদিন পানপ্রেমীদের পাশাপাশি ভিড় জমাচ্ছেন উৎসুক ভোজনপ্রেমীরা।

নাজিরাবাজারের চৌরাস্তাতেই পাবেন ‘আল্লাহর দান জলিলের মিষ্টি পান’সহ আশপাশে ‘কাশ্মীরি মিঠা পান’, ‘মায়ের দোয়া পান বিতানসহ বেশ কিছু মিষ্টি পানের দোকান। তবে আপাতত আগুনের পান খেতে চাইলে জলিল ভাইয়ের পানের দোকান অথবা কাশ্মীরি মিঠা পানই ভরসা। পাবেন ২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বাহারি পান।

নীলক্ষেত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ’ পেরিয়ে এলে প্রথমেই দেখা মেলে ঐতিহাসিক কলাভবনের। কলাভবনের পাশেই রয়েছে ডাকসু। আর ডাকসুর ডান পাশে রয়েছে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সুস্বাদু ও লোভনীয় ফুচকার দোকান। প্রতি প্লেট মাত্র ৩০ টাকা, যাতে ৮টি ফুচকা পরিবেশন করা হয় টকের সঙ্গে।

ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় বসে ভ্যানভর্তি নানান ধরনের ফল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৌসুমি এই ফলগুলো দিয়ে বানানো হয় বিভিন্ন ধরনের ভর্তা। যেমন- কলা ভর্তা, বরই ভর্তা, আমড়া ভর্তা, পেয়ারা ভর্তা প্রভৃতি। যদি আপনি টক এবং ঝাল খেতে পছন্দ করেন, তবে আপনার জিভে জল আনতে এই ভর্তাগুলো বেশ পারদর্শী। যে কোনো ভর্তার দাম এখানে ১০ টাকা থেকে শুরু হয়।

প্রতিনিয়ত মানুষের কাছে বৃদ্ধি পাচ্ছে ভাসমান খাবারের দোকানের চাহিদা। তৈরি হচ্ছে সম্ভাবনাময় ব্যবসার পরিসর। এমনই একটি লাভজনক ব্যবসা ফুড কার্ট বা খাবারের গাড়ি। এটি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে ক্রেতা ও উদ্যোক্তা উভয় পক্ষের কাছে। বিশেষ করে নারী ও স্বল্পপুঁজির মানুষের আয়ের ক্ষেত্র তৈরিতে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে ফুড কার্ট ব্যবসা। তাই স্ট্রিট ফুড শুধু আমাদের মুখরোচক খাবারের স্বাদই দিচ্ছে না, পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সের বেকার শ্রেণির কর্মসংস্থানও হচ্ছে।

খেতে উপাদেয় বা মুখরোচক হলেও কিছু কিছু স্ট্রিট ফুড অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুত ও পরিবেশিত হয় বলে বিভিন্ন জটিল ও মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। তাই এ ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।

More News Of This Category